কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় বিভিন্ন স্থানে হামলা-পাল্টাহামলা হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সমালোচনা করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
সোমবার (১৫ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ আহমেদ তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন তার পোস্টটি নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো-
#চলমান_আন্দোলন ও #Appeal_to_emotion_Fallacy:
একটা গান খুব গাইতে ইচ্ছে করছে-
“জীবন মানে যন্ত্রণা, নয় ফুলের বিছানা, সে কথা সহজে কেউ মানতে চায়না!
চোখ মেলে কেউ দেখেনা, কাঁচের দেয়াল ভাঙে না অসহায়ের সহায় কেউ হইতে চায়না!
মানুষের মাঝে মানুষ চায় শুধু ঠাঁই
এখানে ওখানে, বাঁচার প্রয়োজনে
চলছে লড়াই!”
আমরা কেমন যেন অসম্পূর্ণ আর অশিক্ষাকে পূজা করতে করতে শিক্ষার কবর রচনা করতে শুরু করেছি! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- “অসম্পূর্ণ শিক্ষা আমাদের দৃষ্টিকে নষ্ট করিয়া দেয়—পরের দেশের ভালোটা তো শিখিতে পারিই না, নিজের দেশের ভালোটা দেখিবার শক্তি চলিয়া যায়।”
আমি শিক্ষক, আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসি। তাদের কে শিখানোর চেষ্টা করি! এই যেমন- যুক্তিবিদ্যা পড়ানোর সময় আমি আমার ছাত্রদেরকে লজিক্যাল ফ্যালাসি সম্পর্কে প্রায়ই বলি এবং কিছু ফ্যালাসি অনেক বেশি শেখানোর চেষ্টাও করি । তার মূল কারণ হলো- তারা যাতে দৈনন্দিন জীবনের ভুলভাল যুক্তিতর্ক গুলোকে এড়িয়ে চলতে পারে এবং তার সাথে তারা যেন এসকল যুক্তিগুলোকে চিনতেও পারে।
সেসব ফ্যালাসির মধ্যে অন্যতম একটা ফ্যালাসি হলো #Appeal_to_Emotion_ফ্যালাসি। এটি তখন ই ঘটে যখন কোনো যুক্তি শ্রোতাদের অনুভূতিকে ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করে, আর আসল যুক্তিকে ফাঁকি দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো রাজনৈতিক নেতাকে জিজ্ঞেস করা হয় কেন তাদের সরকার মিলিটারি তে এতো ইনভেস্ট করে যেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন দেশের জন্য খুবই দরকারি। তখন এই ফ্যালাসি অনুযায়ী তার উত্তর হয় এরকম যে, তাহলে আপনারা চান দেশ অরক্ষিত থাকুক? পার্শ্ববর্তী দেশ আমাদের দেশের উপর খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিক?
বিবেচ্য বিষয় এটি যে প্রশ্নের কোথাও এটা বলা ছিল না যে মিলিটারি তে ইনভেস্ট কম করতে চাওয়া মানে হলো দেশকে অরক্ষিত হিসাবে দেখতে চাওয়া। বরং ইনভেস্টমেন্ট প্রায়োরিটি কে হাইলাইট করা যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের জন্য। কিন্তু এখানে ওই রাজনীতিবিদ এই লজিকাল ফ্যালাসি এর মাধ্যমে জনসাধারণ কে এই বার্তা দেয় যে মিলিটারি ইনভেস্ট না করলে দেশ অরক্ষিত হয়ে পড়বে। সুতরাং এই ইনভেস্টমেন্ট জাস্টিফায়েড। সাধারণ জনগণ ও তা খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে এই ইমোশানল কারণে।
ঠিক এমনি চিত্র লক্ষ্য করা যায় চলমান কোটা আন্দোলনের ক্ষেত্রে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ছাত্রছাত্রীরা ইমোশনালি স্লোগান দেওয়া শুরু করলো আর তাদের এই ভুলটাকে পিক করে সরকার জনগণকে ইমোশনাল করা শুরু করলো এই বলে যে, ওরা স্ব-ঘোষিত রাজাকার। আসলে এখানে আন্দোলন এর প্রেক্ষাপট ছিল কোটা পদ্ধতির জাস্টিফিকেশন এবং তার সংস্কার নিয়ে। কিন্তু বর্তমানে যেন এটা #মুক্তিযোদ্ধা vs #রাজাকার ইস্যু হয়ে গেছে। যেখানে আলোচনা বা সমালোচনা হওয়া উচিত ছিল কোটা থাকা না থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে বা সংস্কার নিয়ে, সেখানে সকল আপামর জনগণ কে এই বলে বার্তা দেয়া হচ্ছে যে, যারা কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে তারা দেশবিরোধী i.e. রাজাকার। এভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিণত হলো দেশপ্রেম vs দেশদ্রোহী আন্দোলন এ । এটা একটা Appeal to emotion ফ্যালাসী। এমন ভুলের ফাঁদে ফেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর বর্বরোচিত হামলা একেবারেই অনুচিত!
আশা করি সকলের এ বোধোদয় হবে যে, রাজাকার শব্দ টি কখনো এ আন্দোলনের বিষয়বস্তুই ছিল না। পাবলিক সেন্টিমেন্ট ইমোশনালি ভুলভাবে ব্যবহার করে এই আন্দোলন কে ভুলপথে চালিত করে বা ম্যানিপুলেট করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করা অযৌক্তিক ও অনৈতিক। একজন নীতিবিদ্যা আর যুক্তিবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে এ সত্যটুকু উপলব্ধি ও বলার দায় থেকে লিখলাম । এমন আরও অনেক ফ্যালাসি দিয়ে চলমান পরিস্থিতি কে ব্যাখ্যা করা যায়!
আমি আমার সকল ছাত্র ছাত্রীর নিরাপত্তা চাই। মেয়েদের গায়ের উপর হাত/আঘাত ভয়ংকর কাপুরুষোচিত! এই ছেলেমেয়েরাই দেশের আসল সম্পদ।
Be First to Comment