দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্থান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হলেও পূর্ব পাকিস্থানের জনসাধারণের স্বপ্ন ভঙ্গের শুরু সেদিন থেকেই। বাঙালি চেতনায় প্রথম আঘাত শুরু হয় ভাষার উপর। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলের পর বাঙালীদের প্রথম আদর্শিক আন্দোলন শুরু হয় ভাষা আন্দোলের মধ্য দিয়ে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলের পরিসমাপ্তির পর বাঙালিদের উপর চেপে বসে পশ্চিম পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যের খড়গ। যার সূত্র ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াই আন্দোলের পর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেলাম স্বাধীনতা। বাঙালির সৌভাগ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা এদেশে জন্মে ছিলেন। কেননা আত্মবিস্মৃত এ জাতিকে এক কাতারে দাড় করানো একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়ে ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারে শুরু হয় আরেক আদর্শিক লড়াই আন্দোলন। আবারো অনেক ত্যাগ, অনেক প্রাণের বিনিময়ে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে আমরা সৈরাচার মুক্ত হলাম। বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি শক্তিশালী আদর্শিক দিক বজায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর সেই আদর্শিক চেতনায় দল পরিচালিত হবে। আজ আমরা লক্ষ্য করছি তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতা বা ব্যক্তি কেন্দ্রিক রাজনীতির চর্চ্চাই বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। এখান দলীয় আদর্শ বা জাতীয় রাজনীতি দিন দিন মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় রাজনীতির ধারা ছিল এক সূত্রে গাঁথা। তখন ব্যক্তি কেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চ্চার কোনো সুযোগ ছিল না। সুযোগ সন্ধানীদের রাজনীতি বিলাস আর তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ক্ষমতা আকড়ে ধরার প্রবণতার কারণে এখন আদর্শিক রাজনীতির অপমৃত্যু ঘটেছে।
ফলে রাজনীতি এখন সুযোগ সন্ধানী, ব্যবসায়ী ও আমলা নির্ভর। নেতা হতে হলে এখন সুশিক্ষা, আদর্শ, ত্যাগ আর সুস্থধারার রাজনীতি চর্চ্চার প্রয়োজন নেই। বৈধ-অবৈধ উপায়ে কিছু টাকা কামিয়ে কিছু দিন বড় বড় নেতাদের সিড়ি মাড়িয়ে, সেলফি তোলে সুযোগ বুঝে একটা পদ বাগিয়ে নিতে পারলেই তো কথাই নেই। এখন আর নেতা হতে হলে কর্মী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ নেতাদের ফ্যাক্টরি থেকে এখন শুধু নেতাই পয়দা হয়। অনেকে আবার পদ না পেলে কবিতার ছন্দে কোনো একটা দলের নামের পাশে লীগ/দল/ পার্টি লিখে স্বঘোষিত নেতা বনতেও দেখা যায়। এতে মূল দলের অনুমোদন বা স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়েনা। এলাকায় এসে তারা ছবির সাথে বাহারি পদপদবির বিশাল বিলবোর্ড লাগিয়ে তাদের নেতা হওয়া আগমনী বার্তা প্রচার করতে থাকেন। এলাকায় যাদের রাজনীতিতে কোনো পদচারণা নেই তাদের বড় বড় ছবি না দিলে জনগণ চিনবে কেন? চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ রব পড়ে যায় “অমুকের পুত তমুক দেহি বড় নেতা অইয়া আইছে।” কোন সমস্যা নেই, পকেট গরম তো; তাই লোকের অভাব হবে না। এক শ্রেনির নীতিভ্রষ্টা লোকতো আছেই। দু’পয়সা কামাতে যারা নেড়ার মতো আজ এ নেতার দোয়ারে তো কাল ও নেতার দোয়রে। এসব রেডিমিট নেতাদের আবার অনেকটা সুযোগ করে দিয়েছে ডিজিটাল যুগের ফেইসবুক।
এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি আর ছবি তুলে পোস্ট করলেই হলো। আবার বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে অনেকে সংবাদ শীরোনাম হতেও দেখা যায়। নেতারাও তাদের বিশেষ খাতির সমীহ করতে দেখা যায়। আধিপত্ত বিস্তারে তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন এতই মশগুল যে, দলের সমর্থক বাদ দিয়ে নিজ নামে “সমর্থক গোষ্ঠী” (উপদল) তৈরি করে নিজের পেশি শক্তির জানান দিচ্ছেন। ফলে দলে অভ্যন্তরিন সংঘাত বাড়ছে দিন দিন। এদের দাপটে এলাকার নিরীহ জনগণ টঠস্থ এবং সাধরণ দলীয় কর্মীরা কোণঠাসা। পদ বানিজ্য বন্ধ না হলে উপদলীয় সংঘাত রাজনীতিতে দিন দিন বিষবাষ্প ছড়াবে। আর জন্ম নিবে পাপিয়ার মতো মক্ষীরাণীদের।
জুলফিকার আলী শাহীন
সাংবাদিক ও কলামিস্ট